গণঅভ্যুত্থানের বিকল্প নাই 


গত সোমবার নভেম্বরের বারো তারিখে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তাঁর পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে ‘নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নাই’ শিরোনামে বর্তমান আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখছেন, ‘সুস্থ চিন্তা-ভাবনার লোকদের উদ্বেগের শেষ নাই, কীভাবে আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক পথে রাখা সম্ভব।’ কেন এই উদ্বেগ? মইনুল হোসেন লিখছেন, ছাত্র-জনতা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়িতেছে। আন্দোলনে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পাইতেছে। কোন কোন দায়িত্বশীল নেতা এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন যে, আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের দিকে মোড় নিতেছে। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ এইবারের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করিতেছে বিধায় আন্দোলন যে ঘামিবার নয় তাহাও বুঝিতে কষ্ট হইতেছে না।’

মইনুল হোসেন তাঁর উদ্বেগ খোলাসা করে ব্যক্ত করেছেন বলে তাঁকে একটা বড়োসড়ো ধন্যবাদ জানাতে চাই। আন্দোলন একটি গণঅভ্যুত্থানের দিকে যাচ্ছে, এবং তা ‘যে থামিবার নয়’ এটা টের পেয়ে তিনি সত্যি সত্যিই ভড়কে গেছেন। এই ভয়টা তিনি একা পান নি, তাঁর শ্রেণীর সবাই একটা মহা শংকার মধ্যে পড়েছেন। এই শ্রেণী গণঅভ্যুত্থানকে এতো ভীতির চোখে দেখে কেন? সেটাও মইনুল হোসেন এবং তিনি যে-শ্রেণীর পক্ষে কথা বলেছেন তাদেরকেই চরম মূল্য দিতে হবে। বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যাঁরা রুটি-মাখন গাড়ি-বাড়ি আরাম-আয়েশে-মৌজে আছেন গণঅভ্যুত্থান হলে তাঁদের সেসবের নিশ্চয়তা থাকবে কিনা তার তো আসলেই কোনো গ্যারান্টি নেই।

অতএব, এই শ্রেণীর কাছে নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নাই। গণঅভ্যুত্থানের বিপদ ঘনিয়ে আসছে দেখেও একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কেন এরশাদ রাজি হচ্ছেন না, তার জন্যে মইনুল হোসেন খুবই গোস্বা প্রকাশ করেছেন। এই গোস্বাটা অযৌক্তিক নয়। ‘নিয়মতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হলে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও মইনুল হোসেন যে-শ্রেণীর সদস্য সেই শ্রেণী যে মহা প্রবলেমে পড়বে সে-কথাটাই মইনুল হোসেন তাঁর শ্রেণীর পক্ষে দাঁড়িয়ে খুবই সৎভাবে বলেছেন। এরশাদ সাহের তাঁর কথা শুনেও ফেলতে পারেন। এমনকি আইয়ুব খানের ইতিহাস টেনে এই হুমকিও দেয়া হয়েছে যে, আইয়ুব যান স্রেফ গণআন্দোলনের জন্য ক্ষমতা ছাড়েন নাই। সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান তাঁকে সমর্থন দানে অপারগতা প্রকাশ করায় নাকি আইয়ুব খানের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এই কেচ্ছা কয়ে তিনি যদি এই ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন যে, বাংলাদেশেও প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের ঘুম হারাম হবার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাহলে পাঠককে বলি বাংলাদেশে সামনের দিনগুলিতে কী ঘটবে তার একটা হিশাব আপনারাও করতে পারবেন। এটা স্পষ্ট যে, এইসব কথা তিনি আন্দোলনের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর জন্য বলেন নি। তাঁর নিজ শ্রেণীকে সাবধান করার জন্যই বলেছেন। তবে তিনি স্পষ্ট স্বীকারও করেছেন যে, গণঅভ্যুত্থান বর্তমান আন্দোলনের একটি স্পষ্ট সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যাঁরা গণঅভ্যুত্থান চায় তাঁদের বিরুদ্ধে লেখার জন্যেই তিনি কলম ধরেছেন। তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি । তিনি এটা অবশ্যই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, তাঁর শ্রেণীর জন্যে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ই গণঅভ্যুত্থানের একমাত্র বিকল্প। তাঁর নিবন্ধের ইন্টারেস্টিং যে-দিকটা আমার চোখে পড়েছে তা হোল, পাঠক হয়তো পড়তে পড়তে ভাববে তিনি এরশাদ সরকারের ‘বিকল্প’ কোনো সরকারের প্রস্তাব করছেন। আসলে তিনি হাজির করছেন গণঅভ্যুত্থানের ‘বিকল্প’ পথ।

আন্দোলনের এই রকম ক্রান্তি পর্বে এ ধরনের লেখা মইনুল হোসেন এর আগেও লিখেছেন। ১৯৮৪ সালের ১৪ই মার্চেও প্রায় একই ধরনের কথা তিনি বলেছিলেন। তখনও আন্দোলনের বেগবান গতির বিকল্প হিশাবে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ রাজনীতির তিনি পক্ষাবলম্বন করেছেন এখনকার মতোই। এবং তখন থেকেই তিনি বলে আসছেন ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে মূল সমস্যা হইল শাসনতান্ত্রিক’। শাসনতান্ত্রিক সমস্যা বলতে তিনি কী বোঝান সেটা ভারতের বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকটের উদাহরণ দিয়ে এবার তিনি ৮৪ সালের চেয়েও ভাল করে তাঁর শ্রেণীকে বোঝাতে পেরেছেন যে, আমাদের দেশের জন্য প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার কাম্য নয়। সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান একই ব্যক্তি হওয়ার মধ্যেই হচ্ছে আসল গলদ। পার্লামেন্টারী ধরনের সরকারই ভালো। তাহলে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপ্রধান হিশাবে প্রেসিডেন্ট দুর্যোগ মুহূর্তে সকল দলের ঊর্ধ্বে থেকে সংকট নিরসন করতে পারেন। যেমন, ভারতের প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কটরমণ ভি পি সিং সরকারের পতনের পর চন্দ্রশেখরকে সরকার গঠন করতে দিয়ে ভারতকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। ভারত সংকট থেকে আদৌ উদ্ধার পেল কিনা, নাকি দলছুট ও উগ্র হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল চন্দ্রশেখরকে সরকার গঠন করতে দিয়ে ভেঙ্কটরমণ ভারতীয় সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আরো বড়ো বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন সে-বিতর্ক আমি মইনুল হোসেনের সঙ্গে তুলতে চাই না। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাকে আরো গোড়াসুদ্ধ ভাবার পদ্ধতিটা তাঁর শ্রেণীর জন্যে অপ্রয়োজনীয়। এই শ্রেণীর মূল সমস্যা হচ্ছে কীভাবে নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা নিয়ে বিবদমান বিভিন্ন অংশের একটা আপোসরফার কায়দা প্রবর্তন করা যায়। অতএব, মইনুল হোসেন যখন ‘গণতন্ত্রে’ উত্তরণের কথা বলেন তখন বুঝতে পারি, তিনি আসলে গণতন্ত্রের কথা বলছেন না। তিনি বলছেন আপোসরফার কথা। তাঁর নিজ শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির সমস্যার কথা। সে কারণেই তাঁর শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগী বিভিন্ন অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নিয়ম তিনি প্রবর্তন করতে চান যাতে সংকট সৃষ্টি হলে অন্য শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা না চলে যায়। অন্য শ্রেণী যেন ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করতে না পারে, তাঁর শ্রেণী যে নিয়ম ঠিক করে দেয় তার বাইরে যেন কোনো অনিয়ম না ঘটে। এই শ্রেণী নির্ধারিত ‘নিয়মতান্ত্রিকতা’ যেন সবার ওপর কায়েম রাখা যায়।

ঠিক এখানেই মইনুল হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মৌলিক বিরোধের জায়গা। দীর্ঘকাল ধরে এদেশের জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করছে। সেটা যদি শাসনতান্ত্রিক ভাবে সমাধান করা যেত তাহলে পাকিস্তানী আমলেই আমনা গণতন্ত্র পেয়ে যেতাম। আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই আমরা ‘শাসনতন্ত্র’ নিয়ে মাথা মগজ খরচ করছি। মইনুল হোসেনের বাবা মরহুম তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে ‘শাসনতন্ত্র’ দিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার কাহিনী আমার চেয়েও ভাল ব্যাখ্যা তিনি করতে পারতেন। পাকিস্তানী আমলে ‘শাসনতন্ত্র’ রচনা করতে না করতেই সেনাবাহিনী সিপাহসালার ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইউব খানের নেতৃত্বে সবার পশ্চাৎভাগে রাইফেলের বাঁট মেরে ক্ষমতায় চড়ে বসলো। অস্ত্র এবং বেয়োনেট দ্বারা আইউব খান নিজেকে বৈধ করেছেন, কোনো শাসনতন্ত্র দিয়ে নয়। এই দানবকে সরাতে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসর হতে হয়েছে। যে ‘নৈরাজ্য’ এবং হানাহানিকে এতো ভয়ের চোখে দেখা হচ্ছে, সেটা কিন্তু আমরা এড়াতে পারি নি। বরং আমাদের কয়েক মাত্রা চড়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে।

তারপর শেখ মুজিবর রহমানের কথাই ধরা যাক। তিনি দেশকে আমাদের কারো চেয়ে কম ভালবাসতেন না। এবং গণতন্ত্রের কথা বলেই তিনি আমাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। অথচ এই শেখ মুজিবুর রহমানও একটা ‘শাসনতন্ত্র’ দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের গ্যারান্টি দিতে পারলেন না। এমনকি যে ‘শাসনতন্ত্র’ তিনি আজকে লিখলেন, কালকে নিজেই সেটা বদলালেন। শুধু প্রেসিডেন্ট হিশাবে দেশের সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করাটাই তিনি আবশ্যক মনে করলেন না, একদলীয় বাকশালী শাসনও তিনি প্রবর্তন করলেন। মইনুল হোসেন একই ব্যক্তি সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান হোক এটা চান না। সেটা না হয় তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া গেল, কিন্তু কেন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিকে ঠিক সেই অপকর্মটাই করতে হোল সেটাও তাঁকে ভেবে দেখতে বলি।

তারপর জিয়াউর রহমান এসে ইচ্ছেমতো ‘শাসনতন্ত্র’ পাল্টালেন। শেখ মুজিব যখন করেছেন, জিয়াউর রহমানকে দোষ দেই কীভাবে? ঠিক তেমনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও শাসনতন্ত্রের ওপর বেয়োনেটের খোঁচা মেরেছেন যখনই তাঁর দরকার পড়েছে।

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সমাজের শক্তিশালী শ্রেণী যখন শাসনতন্ত্রকে নিজেদের ইচ্ছা মতো বদলায়, অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় আসে, এবং অস্ত্রের জোরেই নিজেদেরকে বৈধ করে তখন গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে তারাই আবার ‘নিয়মতান্ত্রিক’ রাজনীতির ধুয়ো ধরে কেন? তখন বার বার তারা শাসনতান্ত্রিক সমাধানের পথটাই কেন আমাদের দেখায়? অথচ এই শাসনতন্ত্রটাইতো শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক পার্লামেন্টের অপকর্মে সের দরে বিক্রি করার কাগজে পরিণত হয়েছে। জিয়াউর রহমান আর হুসেইন এরশাদের বদৌলতে এতো ময়লা হয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতা ও একনায়কতান্ত্রিকতার দুর্গন্ধ লাগবে বলে অনেকে আর এটিকে হাতেও তুলে নেবে না। অথচ এই শাসনতন্ত্রটা রক্ষার জন্যেই সমাজের শক্তিশালী শ্রেণীর প্রতিনিধিরা হামেশা আমাদের কাছে ওকালতি করে যাচ্ছেন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাঁরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়বার কাজ হাতে নিয়েছেন তাঁরা জানেন গণতন্ত্রে উত্তরণের সমস্যাটা আমাদের দেশে মোটেও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা নয়। যে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনতন্ত্র অস্ত্রের জোরে জনগণের টুটির ওপর চেপে বসেছে তাকে জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা দ্বারা উৎখাতের সমস্যাটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মৌলিক সমস্যা। সেই উৎখাতের একটা নিয়ম আছে, গতিপ্রক্রিয়া আছে। মইনুল হোসেনের অর্থে নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু তারও একটা নিয়মতন্ত্র আছে। তদুপরি এটাও মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, গণঅভ্যুত্থানের পথ আর নৈরাজ্যের পথ এক নয়। যদিও মইনুল হোসেন গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দেবার জন্যে গণঅভ্যুত্থান থেকে নৈরাজ্য উদ্ভূত হয় বলে দাবি করেছেন। অথচ যে-নৈরাজ্য ও অগণতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনতন্ত্র বিবর্তিত হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি এক্কেবারেই খামোশ। বরং উল্টো সেই নৈরাজ্যের ধারাকে বজায় রাখা এবং তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যই শাসনতান্ত্রিকতার ধুয়ো তোলা হচ্ছে। জনগণের আন্দোলনকে বলা হচ্ছে নৈরাজ্য আর হানাহানি, অথচ ক্ষমতালোভী শ্রেণীর কোন্দল, স্বেচ্ছাচারিতা ও খুনোখুনির কথা বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছে।

অতএব ‘সুস্থ চিন্তাভাবনার লোকদের’ উদ্বেগের কারণ গণঅভ্যুত্থান নয়। বরং নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র, একনায়কতান্ত্রিক সরকার ও সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখার প্রয়াসটাই ভয়ংকর উদ্বেগের।

গণতন্ত্রের মূলকথা ব্যক্তির স্বাধীনতা, তার সার্বভৌম ইচ্ছার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এই ইচ্ছাকে অস্ত্রের জোরে বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কেউ যদি দাবিয়ে রাখে, তাহলে সেই নিপীড়ককে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অপসারণ করার অধিকারকে স্বীকার করাটাও গণতন্ত্র। আমার অধিকার যদি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কেউ হরণ করে নেয় তবে তা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করাটাকে নৈরাজ্য বলা যায় না। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারকে অপসারণের জন্য জনগণ যখন সংগঠিত হয়ে ওঠে এবং সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ প্রভৃতি আন্দোলনকারী সংস্থার মাধ্যমে যখন জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হতে থাকে, তখন একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উদ্ভবের সম্ভাবনাও ক্রমে ক্রমে পরিণতি লাভ করতে পারে। সেটা নির্ভর করে আন্দোলনের সংস্থাগুলো পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারে কিনা এবং একটা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলনের একটি নেতৃত্বদানকারী সংস্থা গড়ে তুলতে পারে কিনা। আন্দোলনকে বিকশিত করার এই পদক্ষেপগুলো মোটেও নৈরাজ্যমূলক নয় কিম্বা অনিয়মতান্ত্রিকও নয়।

বলা বাহুল্য, আন্দোলনের সংস্থাগুলো নিয়মতান্ত্রিক বৈধতা অর্জন করে তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন দ্বারা। কোনো কাগুজে ‘শাসনতন্ত্র’ থেকে নয়। মইনুল হোসেন নিজেই স্বীকার করেছেন ‘আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন বাড়িতেছে’। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থা যতো বেশি জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে ততোই জনগণের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ক্ষমতা এই সংস্থার হাতে পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তখন বিরাজমান রাষ্ট্র ও সরকারকে উৎখাত করাটাই তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এই উৎখাতের মধ্য দিয়েই জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তি হিশাবে নাগরিকরা যে সংস্থাকে তাদের ইচ্ছার প্রতিনিধি গণ্য করে সেই সংস্থার বিজয় মূলত ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের বিজয়। এই বিজয়কে প্রতিষ্ঠিত করার পথই হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের পথ। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থান মোটেও নৈরাজ্যের বা হানাহানির পথ নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এটাই সত্যিকারের নিয়মতান্ত্রিক পথ।

এ পথটাকেই সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণী অনিয়মতান্ত্রিক পথ হিশাবে নাকচ করার কোশেশ করে। অথচ অনিয়মতন্ত্র ও নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখছে তারাই। জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের পথে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে তথাকথিত ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘শাসনতান্ত্রিক’ পথের পার্থক্য যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে এই আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গড়ে ওঠার পর আন্দোলনের বেশ কিছু গুণগত রূপান্তর ঘটেছে, সেটাও হয়তোবা মইনুল হোসেনের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক। আদমজীতে শ্রমিক-ছাত্রজনতার সভা একটি অসাধারণ পদক্ষেপ। এতে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য খুবই সঠিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে সক্ষম। আদমজীতে শ্রমিকদের হত্যার প্রতিবাদে যে মৌন মিছিল তাঁরা শহরে বের করেছেন তার ফলে ছাত্র ও শ্রমিকের মধ্যে সংহতির সূত্রটা আরো দৃঢ় হবে এবং আন্দোলনে একটা বড়ো ধরনের উল্লম্ফন ঘটবে।

দ্বিতীয়ত, গ্রামে ও মফস্বলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ছে। তার মানে কৃষক ও গ্রামীণ জনসাধারণ ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে আস্থাবান হয়ে উঠছে। আমি টাঙ্গাইলে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করবার সময় কৃষকরা ফলাও করে আমাকে বলেছে কীভাবে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সভায় প্রায় দশ হাজার জনসমাগম ঘটেছে যখন অপর একটি বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভায় লোক সমাগম এক হাজারের বেশি ছিল না। কৃষকরা উৎফুল্ল হয়ে আমাকে বর্ণনা করেছে- কীভাবে ছাত্ররা কৃষকদের ঋণ মওকুফের পক্ষে বলেছে, মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে এবং তহশিলদার, ইউনিয়ন কাউন্সিল ও উপজেলা অফিসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে, ইত্যাদি। ছাত্ররা তাদের সত্যিকারের সমস্যা সমাধানের জন্যেও যে লড়ছে এটা শুনেই তারা খুশি। জনগণের কাছে পৌঁছবার, জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি হয়ে ওঠার এই প্রয়াসের পথটাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণঅভ্যুত্থানের দিকে আন্দোলনকে নিয়ে যাবার পথ।

তৃতীয়ত, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ইতোমধ্যেই একটা অভ্যুত্থানের মহড়া দিয়ে বিজয়ী হয়েছে। সেই অভ্যুত্থানটা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সাত বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এটাই হচ্ছে জনগণের প্রথম ও সুস্পষ্ট বিজয়। এই প্রথম জনগণের আন্দোলনের সংস্থা নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিল এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরাজমান রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তৃত্বকে সাফ নাকচ প্রমাণ করল। এই বিজয়ের তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল, যদিও বিজয়টা ক্ষুদ্র হবার কারণে অনেকের নজরে পড়ে নি। এর ফলে আন্দোলনকে এই বিজয় নৈতিক ও গুণগতভাবে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে যা অনেকের মধ্যে সত্যি সত্যি আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিলে অবাক হবার কিছু নেই। খেয়াল করার বিষয় যে, এই গণঅভ্যুত্থানমূলক বিজয়ে কোনো নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটে নি এবং কোনো হানাহানিও হয় নি।

তবুও আমি বলবো সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণীর মতাদর্শিক খপ্পর থেকে আন্দোলন এখনো পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারে নি। আন্দোলন যতোই বেগবান হচ্ছে ততোই শাসনতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা পেশ করা হচ্ছে। শাসনতন্ত্রের মধ্যেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের অনুচ্ছেদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনতন্ত্র যা যেখানে যেমনটি আছে তেমনি রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগাভাগির দিকে আন্দোলনকে নিয়ে যাবার প্রবল চেষ্টা চলছে। কিন্তু যতোই এই চেষ্টা আমরা করি না কেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের কোনো বিকল্প নেই। এটাই অনিয়মতন্ত্র, স্বেচ্ছাচার ও নৈরাজ্যের ভিত্তি ও ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্র, শাসনতন্ত্র ও সরকারকে উৎখাত করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।

১ অগ্রহায়ণ, ১৩৯৭ ।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।